পানি পানের উপকারিতা আর কিছু ভুল ধারণা

হ্যালো বন্ধুরা!

“পানিই জীবন,পানিই স্বাস্থ্য” এই কথাটি ছোটকাল থেকে শুনে আমরা বড় হয়েছি। আসলেই স্বাস্থ্যের জন্য পানির গুরুত্ব বলে বোঝানোর নয়।মানব শরীরের গড়ে ৫০-৬৫ শতাংশ হলো পানি। শিশুদের শরীরে সবচেয়ে বেশি পানি নবজাতকদের শরীরের ৭৮ শতাংশ পানি।

তাই আজকে আপনাদের জন্য বাংলায় আমাদের চতুর্থ ব্লগ #HealthTherapy এর পানি পানের উপকারিতা আর কিছু ভুল ধারণা নিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ: বেশির ভাগ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ লোকের দৈনিক চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজন ৭ দশমিক ৫ লিটার পানি। প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করতে হবে তা দেহের উচ্চতা ও কাজের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।

উপকারিতা :

সংযুক্ত স্থানগুলো পিচ্ছিল করতে :

শরীরের যে অঙ্গগুলো সংযুক্ত অবস্থায় থাকে, সেখানে কার্টিলেজের উপস্থিতি থাকে। শারীরিক কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য কার্টিলেজে ৮০ শতাংশ পানির উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় পানি পান না করলে এই স্থানগুলো শুকিয়ে গিয়ে ব্যথা হতে পারে।

পরিপাকতন্ত্রে :

নিয়মিত পানি পান করলে লালাগ্রন্থি শুকিয়ে যায় না বলে সহজে খাবার হজম হয়। পানির কারণে মুখ, নাক, চোখ ভেজা থাকে, যা বিভিন্ন সময় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এই অঙ্গগুলোকে। মিষ্টি খাওযার পর পানি পান দাঁতকে ক্ষয় থেকে বাঁচায়।

শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছানো :

রক্তে পানির পরিমাণ ৯০ শতাংশেরও বেশি। রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে দেয় অর্থাৎ পানিও শরীরের সব অংশে পৌঁছে যায়।

ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় :

পানির অভাবে ত্বক রুক্ষ হয়ে যেতে পারে। সঙ্গে দেখা দিতে পারে অনাকাক্সিক্ষত ভাঁজ।

মস্তিষ্কের নিরাপত্তায় :

মস্তিষ্কের গঠন এবং কার্যকারিতায় পানির গুরুত্ব অনেক বেশি। দীর্ঘ সময় পানি পান না করলে স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হজম সমস্যা দূর করে :

হজম সমস্যা সমাধানে, কোষ্ঠকাঠিন্য, এসিডিক সমস্যায় পানি পান করা জরুরি। পাকস্থলীর আলসার এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে ডিহাইড্রেশনের কারণে।

ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখে :

শরীরে পানি কম প্রবেশ করলে রক্ত পাতলা হয়ে দেখা দিতে পারে ব্লাড প্রেশার।

কিডনির সমস্যা :

কিডনি শরীরের তরল পদার্থ নিয়ন্ত্রণ করে। অপর্যাপ্ত পানির কারণে কিডনিতে পাথর ছাড়াও দেখা দিতে পারে নানা সমস্যা।

মানুষের দেহের প্রতিটি কোষেরই সুস্থ থাকার জন্য পানির দরকার হয়। তবে গরমের সময় একটু বাড়তি সতর্কতা লাগে। শরীরে পানিশূন্যতা সম্পর্কিত অনেক গুজব বা ভুল ধারণাও প্রচলিত আছে। এখানে এমন ৭টি ধারণার খণ্ডন করে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া হলো :

১. গুজব : পানিশূন্যতা অস্বস্তিকর কিন্তু বিপজ্জনক নয়।

সত্য : শরীরে পানিশূন্যতার কারণে আমরা প্রায়ই হয়তো হালকা মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, প্রস্রাব কম হওয়া বা ঘাম কম বের হওয়ার মতো সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু এতে কোনো সমস্যা মারাত্মক রুপও ধারণ করতে পারে এবং এমনকি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার দরকার হতে পারে। পানিশূন্যতা মস্তিষ্ক ফুলে যাওয়া, কিডনির কার্যক্রমে ব্যর্থতা এবং পরিণতিতে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।

২. গুজব : আপনি যদি তৃষ্ণা বোধ করেন তাহলে ধরে নিতে হবে আপনি ইতিমধ্যেই পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছেন।

সত্য : তৃষ্ণার অনুভুতি আপনাকে পানি পানের জন্য তাগাদা দেয়। তবে যখন আপনি তৃষ্ণার্ত অনুভব করবেন তখন যে আপনি বিপজ্জনকভাবে পানিশূন্যতায় আক্রান্ত হয়েছেন এমনটা ভাবা ঠিক নয়। এমনও হতে পারে মাত্র ১% পানিশূন্যতার কারণে আপনি তৃষ্ণার্ত হয়েছেন। ফলে সামান্য তরল পানেই হয়তো আপনার তৃষ্ণা কেটে যাবে।

৩. গুজব : একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি পান করা দরকার।

সত্য : এই সেকেলে ধারণাটি এখনো মূলত বোতলজাত পানি কম্পানিগুলোর কারণেই বেশি প্রচারণা পাচ্ছে। তাহলে প্রকৃতই আপনার প্রতিদিন কত গ্লাস পানি পান করা দরকার? দ্য ইনস্টিটিউট অব মেডিসিন (আইওএম) এর পরামর্শ মতে, একজন পুরুষের প্রতিদিন গড়ে ৩ লিটার পানি পান করা দরকার। অন্যদিকে, একজন নারীর দরকার প্রতিদিন গড়ে ২.২ লিটার পানি পান করা। তবে অন্যদের মতে, তৃষ্ণার্ত না হলে জোর করে পানি পান করার দরকার নেই।

৪. গুজব : প্রস্রাব পরিষ্কার থাকলে বুঝতে হবে শরীর পর্যাপ্ত আর্দ্র আছে।

সত্য : প্রস্রাব পরিষ্কার থাকলেই যে আপনার শরীর পানিশূন্যতায় ভুগছে না এমনটা ভাবা ঠিক নয়। বরং আপনার দেহে যথেষ্ট আর্দ্রতা বজায় থাকার লক্ষণ হলো আপনার পেশাবের রং হালকা হলুদ হওয়া।

৫. গুজব : অতিরিক্ত আর্দ্রতা বলে কিছুই নেই

সত্য : অতি আর্দ্রতাও মারাত্মক বিপজ্জনক হতে পারে। তবে এমনটা খুব কমই ঘটে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি পানে হাইপোন্যাট্রেমিয়া নামের রোগ হতে পারে। এতে দেহে সোডিয়ামের মাত্রা এতটাই মিশে যায় যে, দেহকোষগুলো ফুলে যেতে শুরু করে। হাইপোন্যাট্রেমিয়ার লক্ষণগুলো হলো- ক্ষুধামান্দ্য, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা, মানসিক বিশৃঙ্খলা ও অবসাদ। এমনকি এতে খিঁচুনি এবং কোমার মতো পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতে পারে।

৬. গুজব : শরীরচর্চাকারীদের ক্রীড়া পানীয় দরকার হয়। সত্য : আপনি যদি এক ঘণ্টা বা তার কম সময় ধরে শরীরচর্চা করেন তাহলে শুধু পানি পান করলেই চলবে। তবে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শরীরচর্চা করলে গ্লুকোজ জাতীয় পানীয় পান করার দরকার পড়বে।

৭. গুজব : কফি পান করলে দেহ অনার্দ্র হয়ে পড়ে।

সত্য : অতিরিক্ত কফি পানেই শুধু এমনটা ঘটতে পারে। তবে স্বাভাবিক মাত্রায় কফি পানে আপনার দেহে বরং প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহ হবে। তবে প্রতিদিন ৫০০ গ্রাম বা এর বেশি পরিমাণ কফি পানে দেহ অনার্দ্রতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

গরমে আমরা কম বেশি থান্ডা পানি পান করে থাকি। তীব্র গরমে ফ্রিজের ঠান্ডা পানিই যেন একমাত্র মহৌষধ। কিন্ত এ স্বস্তিই একদিন আপনার কাল হতে পারে। বিপন্ন করে তুলতে পারে জীবনকে কারণ ঠান্ডা পানি পান স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়।

তবে সবসময় ঠান্ডা পানি খাওয়া কি শরীরের জন্য উপকারী? আসুন জেনে নেই ঠান্ডা পানি খাওয়ার কুফল।
১. বিশেষজ্ঞদের মতে, খাওয়ার পরে ঠান্ডা পানি পানের অভ্যাস অস্বাস্থ্যকর। কারণ, এর ফলে শ্বাসনালীতে অতিরিক্ত পরিমাণে শ্লেষ্মার আস্তরণ তৈরি হয়, যা থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২. মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পানের ফলে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পানে আমাদের স্বাভাবিক পরিপাকক্রিয়াও বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে হজমের মারাত্মক সমস্যা হতে পারে।

৩. শরীরচর্চা বা ওয়ার্কআউটের পর ঠান্ডা পানি একেবারেই পান করা যাবে না। কারণ, ঘণ্টাখানেক ওয়ার্কআউটের পর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেড়ে যায়। এ সময় ঠান্ডা পানি পান করলে শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রার সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হয়। ফলে হজমের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়ার্কআউটের পর ঠান্ডা পানির পরিবর্তে কুসুম গরম পানি পান করলে বেশি উপকার পাওয়া যাবে।

৪. দন্ত চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পানের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে দাঁতের ভেগাস স্নায়ুর ওপর। এই ভেগাস স্নায়ু আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করলে ভেগাস স্নায়ু উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। ফলে আমাদের হৃদযন্ত্রের গতি অনেকটা কমে যেতে পারে।
তাই ঠান্ডা পানি পানের অভ্যাস থাকলে বদলে ফেলুন।

পানি পানের পরিমাণ এবং পদ্ধতি:
# সকালে খালি পেটে এক গ্লাস বা আড়াইশ মিলিলিটার পানি পান করতে হবে।

# খাওয়ার ঠিক পরপরই পানি খাওয়া যাবে না। বরং পুরো খাওয়ার মাঝে এক কাপ পরিমাণ বা দেড়শ মিলিলিটার পানি পান করতে হবে, চুমুকে চুমুকে।

# দুপুরের খাওয়ার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত এক ঘণ্টা পরপর এক’দুই চুমুক পানি পান করতে হবে।

# পানি মুখে নিয়ে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড রেখে তারপর গলাধঃকরণ করা উচিত।

# সবসময় ফুটানোর পানি পান করতে হবে। ফুটানোর ১২ ঘণ্টা পর ওই পানি পান না করাই ভালো।
পানি পানের স্বাস্থ্যকর পরিমাণ নির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এটি নির্ভর করে আবহাওয়া এবং একজন ব্যক্তির শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণের উপর। পাশাপাশি সারাদিন অন্যান্য তরল কতটা পান করা হচ্ছে সেটাও হিসেবে রাখতে হবে।
দৈনন্দিন খুঁটিনাটি সমস্যাগুলো সারাতে পানি পান করা সমস্যাগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে।
মনে রাখতে হবে, পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করতে, কুসুম গরম পানি পান করতে হবে, এবং ধীরে পান করতে হবে।

সবাই ভালো থাকুন,নিরাপদ থাকুন।

Dr. Fatema Tabassum Anam
Health Activist & PR officer
Tooth Fairy Foundation.